বাজেট

বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন করা হয় ১২ মাসের জন্য যা চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত কার্যকর থাকে। প্রতি বছর জুন মাসে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সরকারের পক্ষে অর্থমন্ত্রী বাজেট বিল পেশ করেন। তাই বাজেটের খুটিনাটি বিষয় নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন।

বাজেট

‘বাজেট” (Budget) ইংরেজি শব্দ। ফরাসি শব্দ bougette থেকে Budget শব্দটি এসেছে। যার বাংলা অর্থ চামড়ার থলে বা ব্যাগ। অতীতে থলেতে ভরে দেশের আয়-ব্যয়ের হিসাব আইনসভা বা সংসদে আনা হতো বলে একে ‘বাজেট’ নামে অভিহিত করা হয়।

ইতিহাস

১৪ মার্চ ১৭৩৩ যুক্তরাজ্যের তথা বিশ্বের প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার রবার্ট ওয়ার্লপোল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ বা হাউস অব কমন্সে প্রথম জাতীয় বাজেট ও রাজস্বনীতি ‘পুস্তিকা’ বা প্যালেট আকারে উত্থাপন করেন। এ পুস্তিকা ছিল অনেকটা চিঠির মতো। তবে ১৭৬০ সালে বাজেট আনুষ্ঠানিক রূপ পায়। ১৭৬৪ সালে গ্রেট ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে বাজেট অধিবেশনে জর্জ গ্রিনভিল স্ট্যাম্প আইনের কথা বলেন।

আরো পড়ুন : টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (Sustainable Development Goals)’র A টু Z

যুক্তরাজ্যে শুরুতে বসন্তকালে বাজেট দিবস অনুষ্ঠিত হতো। কারণ জনগণের কাছ থেকে ভূমি রাজস্ব আদায় করা হতো এপ্রিল মাসে এবং এর বেশিরভাগ অর্থ আসতো কৃষিখাত থেকে। আধুনিক শিল্প অর্থনীতিতে সরকারের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে এ বাজেট। ২৯ নভেম্বর ১৮৫৯ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টন কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে জেমস উইলসন ভারতে ভাইসরয়ের কাউন্সিলে অর্থ সদস্য (মন্ত্রী সমতুল্য) হিসেবে নিয়োগ পান।

৭ এপ্রিল ১৮৬০ জেমস উইলসন ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম বাজেট আনুষ্ঠানিকভাবে আইনসভায় পেশ করেন। তিনিই প্রথম বাজেটে আধুনিক আয়কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। উপমহাদেশে উইলসনই প্রথম গণতান্ত্রিক ওয়েস্ট মিনস্টার টাইপের সরকার পদ্ধতির “আওতায় সরকারের আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনার বাজেট পেশ করেন, যা আজও বাংলাদেশে বিদ্যমান।

বাজেট কেন

উৎপাদন, উন্নয়ন ও কল্যাণ— একটি দেশের বাজেটের মূলত এই তিনটি প্রধান লক্ষ্য থাকে। যেকোনো বাজেটের দুটি দিক থাকে। এর প্রথমটি ফিস্ক্যাল দিক আর একটি মনিটারি দিক বাজেটের মূল লক্ষ্য— জিডিপি প্রবৃদ্ধি কতটা অর্জিত হবে, মূল্যস্ফীতি কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে, ঘাটতি কীভাবে কমিয়ে আনা যাবে এবং দারিদ্র্য বিমোচন কীভাবে সম্ভব হবে।

প্রকারভেদ

বাজেটের ২টি অংশ— (ক) রাজস্ব বাজেট ও (খ) উন্নয়ন বাজেট বা মূলধন বাজেট। রাজস্ব বাজেটে আয়ের উৎস হিসেবে ব্যক্তি পর্যায়ে আয়কর, দান-কর, উত্তরাধিকার কর, ধন-সম্পত্তির ওপর কর, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক, ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর, প্রমোদ কর আরোপ করা হয়। বাজেটের প্রসারিত শ্রেণীবিভাগ হিসেবে বাজেট ২ প্রকার— (ক) ভারসাম্য বা সমতাপ্রাপ্ত বাজেট ও (খ) ভারসাম্যহীন বা সমতাহীন বাজেট। ভারসাম্যহীন বাজেট আবার ২ প্রকার—

  • উদ্বৃত্ত বাজেট এবং
  • ঘাটতি বাজেট।

অন্যভাবে বললে বাজেট ৩ প্রকার—

  • উদ্বৃত্ত বাজেট
  • ভারসাম্য বাজেট
  • ঘাটতি বাজেট।

বাজেটের কিছু সংজ্ঞা

  • উদ্বৃত্ত বাজেট : কোনো আর্থিক বছরে সরকারের প্রত্যাশিত আয় অপেক্ষা সম্ভাব্য ব্যয়ের পরিমাণ কম হলে, সেটাই উদ্বৃত্ত বাজেট। অর্থাৎ, এ বাজেটে ব্যয় অপেক্ষা আয়ের পরিমাণ বেশি।
  • ঘাটতি বাজেট : কোনো আর্থিক বছরে সরকারের প্রত্যাশিত আয় অপেক্ষা ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হলে তাই ঘাটতি বাজেট। |
  • সম্পূরক বাজেট : বরাদ্দকৃত ব্যয়ের চাইতে কোনো মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যয় বৃদ্ধি হলে তা অনুমোদন করতে যে বিল পাস করা হয় বা নতুন যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তাই মূলত সম্পূরক বাজেট।
  • উন্নয়ন বা মূলধনী বাজেট : এ বাজেটে সরকার গৃহীত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য আয় ও ব্যয়ের হিসাব দেখানো হয়।

মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো (MTBF)

এটি হলো এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে এক বছরের বাজেট বরাদ্দ এবং তার পরবর্তী বছরের বাজেটে কী ধরনের বরাদ্দ থাকবে তা নির্ধারণ করা হয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) অর্থ মন্ত্রণালয়ের (Ministry of Finance-MoF) অন্তর্গত অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (Internal Resource Division – IRD) নিয়ন্ত্রণাধীন। ১৯৭২ সালে NBR প্রতিষ্ঠা করা হয়। NBR’র পূর্নরূপ হলো National Board of Revenue। NBR এর গঠনগত বিভাগ ৩টি — আয় কর, ভ্যাট (আবগারি শুল্কসহ) এবং কাস্টমস ডিউটি (আমদানি শুল্ক)। NBR’র মূল কাজ রাজস্ব সংগ্রহ, কর সংগ্রহের নীতমালা প্রণয়ন, রাজস্ব সংগ্রহের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, সরকারের রাজস্ব বাজেট প্রণয়নে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহে সহায়তা প্রদান ইত্যাদি।

কর (Tax)

কর এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Tax এসেছে ল্যাটিন শব্দ Taxo বা ‘ট্যাক্সো’ থেকে। এর অর্থ একটি আজ্ঞাধীন আর্থিক মূল্য। Tax বা কর হলো সরকারের কাছে নাগরিকদের অর্থ প্রদানের একটি বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা, এর মাধ্যমে সরকার দেশের উন্নতির জন্য নাগরিকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। এটি একটি আর্থিক দায় যা নাগরিকদের সরকারি আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে কাজ করে। কর ব্যবস্থা দুটি প্রধান বিভাগে বিভক্ত প্রত্যক্ষ কর এবং পরোক্ষ কর। ব্যক্তি এবং কর্পোরেশনের আয় বা সম্পদের উপর প্রত্যক্ষ কর ধার্য করা হয় ৷

প্রত্যক্ষ কর

  • আয়কর (Income Tax) : এটি একটি প্রত্যক্ষ কর যা একটি অর্থ বছরে ব্যক্তি এবং কর্পোরেশন দ্বারা অর্জিত আয়ের ওপর আরোপ করা হয়। আয়করের হার আয়ের স্তর এবং করদাতার প্রকারের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।
  • ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স (CGT) : এটি একটি প্রত্যক্ষ কর যা মূলধন সম্পদ যেমন শেয়ার, সম্পত্তি, বন্ড ইত্যাদি স্থানান্তর থেকে উদ্ভূত লাভ বা ক্ষতির উপর আরোপ করা হয়। মূলধন লাভ করের হার সম্পদের ধরন এবং ধারণকালের উপর নির্ভর করে।
  • কর্পোরেট ট্যাক্স : এটি একটি প্রত্যক্ষ কর যা একটি আর্থিক বছরে কোম্পানি দ্বারা অর্জিত লাভের উপর আরোপ করা হয়। উল্লেখিত আয়কর, ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স ও কর্পোরেট ট্যাক্স, আয়কর আইন, ১৯৬১ অনুযায়ী সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্স দ্বারা পরিচালিত হয়।
  • সম্পত্তি কর (Wealth Tax) : যদি কোনো ব্যক্তির সম্পত্তির মূল্য ৩০ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যায়, তবে অতিরিক্ত অংশের ১% কর হিসাবে প্রদান করতে হয়। ২০১৫ সালে ঘোষিত বাজেটে এ করব্যবস্থার অবসান ঘটে। তারপরে, এটি প্রতি বছর ১ কোটি টাকার বেশি আয় করা ব্যক্তিদের উপর ১২% শুল্ক দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। এটি সেই সব সংস্থার উপরও প্রযোজ্য যারা প্রতি বছর ১০ কোটি টাকার বেশি আয় করে থাকে।
  • উপহার কর (Gift Tax) : ১৯৯৮ সালের নিয়ম অনুযায়ী, পরিবারের সদস্যদের এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া উপহারগুলো করমুক্ত। অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া ৫০,০০০ টাকার বেশি উপহারগুলি সম্পূর্ণরূপে করযোগ্য।
  • সিকিউরিটিজ ট্রানজেকশন ট্যাক্স (STT) : এটি হলো ভারতে স্বীকৃত স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে স্টক, মিউচুয়াল ফান্ড এবং ডেরিভেটিভগুলির মতো সিকিউরিটি ক্রয়- বিক্রয়ের উপর আরোপিত একটি কর।

পরোক্ষ কর

  • কাস্টমস ডিউটি : এটি একটি পরোক্ষ কর যা জাতীয় সীমানা জুড়ে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির উপর আরোপ করা হয়। শুল্ক কাস্টমস অ্যাক্ট, ১৯৬২ দ্বারা পরিচালিত হয় এবং সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (CBIC) দ্বারা পরিচালিত হয়।
  • এক্সাইজ ডিউটি : এটি হলো ভারতে উৎপাদিত পণ্যের উপর আরোপিত এক ধরনের কর। এটি কাস্টমস ডিউটি থেকে ভিন্ন, কারণ এটি শুধুমাত্র দেশীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
  • পণ্য ও পরিষেবা কর (GST) : এটি একটি পরোক্ষ কর যা আগের অনেক পরোক্ষ কর যেমন বিক্রয় কর, পরিষেবা কর, মূল্য সংযোজন কর, ইত্যাদিকে প্রতিস্থাপন করেছে। GST হলো একটি ব্যাপক কর যা পণ্য ও পরিষেবার সরবরাহের উপর আরোপ করা হয়।
  • বিক্রয়কর (Sales Tax) : বিক্রয় কর হলো পণ্য ও সেবা বিক্রির উপর আরোপিত এক ধরনের খরচ। এটি সাধারণত কেনা পণ্যের খুচরা মূল্যের একটি শতাংশ হিসেবে নির্ধারিত হয়। বিক্রয়কর বিক্রেতারা সংগ্রহ করেন এবং সরকারকে জমা দেন।
  • পরিষেবা কর (Service Tax) : পরিষেবা কর ১৫% হারে ধার্য করা হয় এবং এটি কোম্পানিগুলি দ্বারা প্রদত্ত পরিষেবাগুলিতে প্রযোজ্য। অস্পষ্টতা এড়াতে রেস্তোরাঁগুলো মোট বিলের ৪০% এর ওপর পরিষেবা কর ধার্য করে।
  • মূল্য সংযোজন কর (VAT) : Value Added Taxes (VAT) বা মূল্য সংযোজন কর বা মূসক হচ্ছে একটি পরোক্ষ কর। সহজ ভাবে বলা যায় যে, কোন ক্রেতা যখন কোন পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, তার মূল্যের অতিরিক্ত যে কর তিনি দিয়ে থাকেন, সেটি হচ্ছে ভ্যাট বা মূসক। কোন পণ্য বা সেবার সর্বশেষ ভোক্তা বা ক্রেতাই সেই পণ্য বা সেবার মূসক দাতা। ১ জুলাই ১৯৯১ থেকে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বা মূসক চালু করা হয়। বাংলাদেশে পণ্য বা সেবার উপর ১৫% মূসক আরোপের নিয়ম রয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১.৫%- ১০% মূসকও নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

রাজস্ব নীতি

প্রসারিত দৃষ্টিতে, রাজস্ব নীতি বলতে সরকারের আয়- ব্যয় সংক্রান্ত নীতিকে বোঝানো হলেও সংকীর্ণ দৃষ্টিতে সরকারের ব্যয় এবং কর-এ দু’য়ের সমন্বিত বাজেট নীতিকে রাজস্ব নীতি (Fiscal Policy) বলে। রাজস্ব নীতির গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা ও নিয়োগ সম্প্রসারণ।

TIN

Tax Identification Number (TIN) হলো একটি নয়- সংখ্যার নম্বর যা অভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবা (IRS) দ্বারা করদাতাদের শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশে জমি ক্রয়-বিক্রয়, আয়কর, ব্যাংক থেকে ঋণ বা সঞ্চয়, ব্যবসায়িক লাইসেন্স বা টেন্ডার ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে TIN প্রযোজ্য।

Related Post

Leave a Comment