অর্থনৈতিক অঞ্চল

২০৩০ সালের মধ্যে সারাদেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্য ছিল শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও বিকেন্দ্রিকরণ। পাশাপাশি, এক কোটি কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। এজন্য ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন, ২০১০’-এর বিধান অনুসারে ২০১০ সালের ৯ নভেম্বর গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ’ (বেজা)। সংস্থাটি ইতোমধ্যে ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে। একনজরে চিত্রটি দেখে নেওয়া যাক—

  • সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ৬৮টি এবং বেসরকারি ২৯টি।
  • সরকারি, বেসরকারি, পিপিপি এবং জিটুজিসহ ৬ ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে।
  • সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে গঠিত হচ্ছে ২টি, জি-টু-জি ভিত্তিতে ৪টি এবং ৮টি পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি খাতের উদ্যোগে।
  • ট্যুরিজম পার্কের মোট সংখ্যা ৩।
  • এ পর্যন্ত অধিগ্রহণকৃত জমির পরিমাণ ৬২ হাজার একর।
  • বর্তমানে ১১টি অঞ্চল চালু রয়েছে। ২৮টি অঞ্চল নিয়ে কাজ চলছে।
  • সর্বশেষ ৫ মার্চ সিটি গ্রুপকে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে ‘পুবগাঁও ইকোনমিক জোন’ অঞ্চল স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর দেশের সর্বপ্রথম পরিকল্পিত ও স্মার্ট নগর। মোট আয়তন ৩৩ হাজার একর। এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক ও শিল্প জোন। শিল্পনগরীটি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। ২০১৬ সালে ‘মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল’ নামে এর উদ্বোধন হয়।

আরো পড়ুন : কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স জুন ২০২৪ থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর

২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে মিরসরাই-সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজীর সীমানাজুড়ে গড়ে উঠা তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল মিলিয়ে এর নাম রাখা হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’। শিল্পনগরীর পরিকল্পনাগুলো এরকম—

  • বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের সঙ্গে সারাদেশের মহাসড়ক, নদী, সমুদ্র ও রেলপথে সংযোগের অনন্য সুযোগ রয়েছে। মিরসরাই-সীতাকুণ্ড ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের উপকূলভাগের সুবিধা কাজে লাগিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে কনটেইনার বন্দর। তাছাড়া কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেল হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ‘সুপার ডাইক-কাম- মেরিন ড্রাইভওয়ে’-এর সঙ্গে যুক্ত হবে নগরীটি। এর পাশেই রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেলপথ। সেখানে নির্মিত হবে হাইস্পিড রেললাইন। নগরীটি যুক্ত হবে নোয়াখালী-চট্টগ্রাম বাইপাস মহাসড়কে। সমুদ্রপথের ব্যবহার বাড়াতে তৈরি হবে জেটি ও লজিস্টিক সুবিধা। পরিকল্পনা রয়েছে বিমানবন্দর নির্মাণেরও।
  • শিল্পনগরে হালকা, মাঝারি ও ভারীসহ সব ধরনের শিল্প গড়ে উঠবে। কারখানা হবে ১৭ হাজার একর ভূমিতে।
  • বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) অধীনে এই জোনে এক হাজার ১৫০ একর জায়গায় গড়ে উঠছে ইপিজেড।
  • নিশ্চিত করা হবে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা। তাই নগরীর বাকি প্রায় অর্ধেক অংশে থাকবে আবাসন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-প্রশিক্ষণের সুবিধা, বিনোদন কেন্দ্র এবং উন্মুক্ত স্থান।
  • শিল্পনগরে ওয়ান স্টপ সার্ভিস পাওয়া যাবে। অবকাঠামোগত সুবিধা হিসেবে থাকবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গ্যাস ও পানির সংযোগ, কেন্দ্ৰীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি শোধনাগার, আবাসন, হাসপাতাল, প্রশাসনিক ভবন ইত্যাদি।
  • জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য শিল্পনগরকে কেন্দ্র করে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের বেষ্টনী ও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
  • শিল্পনগরীটি হতে চলেছে দেশের প্রথম ‘সবুজ শিল্পনগরী’।

শিল্পনগরীর যেসব মাইলফলক

  • ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর প্রথমবারের মতো এই শিল্পনগর থেকে পণ্য রপ্তানি শুরু হয়।
  • শিল্পনগরে দেশের প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির কারখানা স্থাপনের কাজ চলছে।
  • বেজা এবং বিজিএমইএ-এর মধ্যে শিল্পনগরে একটি বিশেষায়িত গার্মেন্টস পল্লী স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
  • এ নগরে বিনিয়োগ করছে জাপানের বিখ্যাত নিপ্পন স্টিল, সজিত করপোরেশন, ভারতের এশিয়ান পেইন্টস, যুক্তরাজ্যের বার্জার পেইন্টস, চীনের জিনদুন গ্রুপ এবং বাংলাদেশের শীর্ষ শিল্প গ্রুপগুলো।

নানা দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল

জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল : ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় বাংলাদেশে একটি জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা হয়। ২০১৯ সালে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান সুমিতমো করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে বেজা। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর। ২০২৪ সালের ২১ মার্চ বহুজাতিক ইলেকট্রনিক্স এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্স নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই অঞ্চলে পণ্য উৎপাদন শুরু করে।

চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল : ২০১৪ সালের জুনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে চীন চট্টগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের আগ্রহ দেখায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একনেকে চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ১১ আগস্ট স্বাক্ষরিত হয় সমঝোতা স্মারক। এর আলোকে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্প অঞ্চল গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয় চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ কর্পোরেশনকে। ৭৭৮ একর এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা এই অঞ্চলে থাকছে কেমিক্যাল, অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলি, গার্মেন্টস ও ওষুধ কারখানা।

ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরীর সাব জোন-১৯-এ ৮৫৭ একর ভূমির ওপর স্থাপিত হচ্ছে ভারতীয় অর্থনেতিক অঞ্চল। এজন্য ‘মিরসরাইয়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন’ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ‘আদানি পোর্টস অ্যান্ড এসইজেড’ ভারত সরকারের নির্বাচিত ডেভেলপার হিসেবে এই অঞ্চলের উন্নয়নে যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে, ভারত সরকারের সঙ্গে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে বেজা আরেকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে বাগেরহাটের মোংলা বন্দরের পাশে ১১০ একর জমি বরাদ্দ করেছে।

পদ্মা সেতু ও অর্থনৈতিক অঞ্চল

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সেতুটি ঘিরে ঢাকা, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে ১৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ এগিয়ে নিতে চাচ্ছে বেজা। বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় ২০৫ একর জমি নিয়ে বন্দর-সংলগ্ন এলাকায় স্থাপিত হয়েছে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। এটি বাস্তবায়িত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে।

এটির পাশেই ১০৫ একর জমি নিয়ে স্থাপন করা হচ্ছে আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল, যা জি-টু-জি ভিত্তিতে ভারত সরকারের নিযুক্ত ডেভেলপারের সাহায্যে বাস্তবায়িত হবে। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার মাওয়ার কাছে ৮০০ একর জমি নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে।

এছাড়া দুটি করে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হতে যাচ্ছে খুলনা, বরিশাল ও শরীয়তপুরে। একটি করে অঞ্চল হবে মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাগুরা, সাতক্ষীরা, ভোলা ও কুষ্টিয়া জেলায়। এগুলো বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের পরিকল্পিত শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হবে।

প্রধান আরও কয়েকটি অঞ্চল

  • কক্সবাজারের মহেশখালীতে ২৯০০ একর জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ শুরু হয়েছে, যেখানে বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপ। এই অর্থনৈতিক অঞ্চলেই নির্মিত হচ্ছে দেশের বৃহৎ তেল পরিশোধানাগারসহ পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প।
  • সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাশে প্রায় ১০০০ একর জমিতে স্থাপিত হচ্ছে দেশের বৃহত্তম বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ‘সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল’।
  • সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার সংযোগস্থল শেরপুরে নির্মিত হয়েছে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল’।
  • গাজীপুরে উৎপাদন শুরু করেছে ‘বে অর্থনৈতিক অঞ্চল’, যেখানে বিনিয়োগ করেছে চীন ও তাইওয়ানের দুটি প্রতিষ্ঠান।
  • মুন্সীগঞ্জে উৎপাদন শুরু করেছে হোসেন্দি ও আব্দুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চল। আব্দুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প নির্মাণ করেছে জাপানের হোন্ডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান।
  • নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় রয়েছে ‘মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন’, যেখানে নির্মিত হয়েছে ৭টি বিদেশি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠান।

মহাপরিকল্পনায় ট্যুরিজম পার্ক

দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করতে বেজা বিভিন্ন স্থানে ৩টি ট্যুরিজম পার্কের পরিকল্পনা করেছে। এগুলো হলো : মহেশখালী উপজেলায় সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক এবং টেকনাফ উপজেলায় নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক। টেকনাফে সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম বিশেষায়িত ট্যুরিজম পার্ক সাবরাং। এখানে ৭টি প্রতিষ্ঠান ৯৪.৪৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

এই পার্কে থাকছে ইকো-ট্যুরিজম, মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম, সি-ক্রুজ, বিদেশি পর্যটকদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা, সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের বিশেষ ব্যবস্থা, ভাসমান জেটি, শিশু পার্ক, ইকো-কটেজ, ওশেনেরিয়াম, আন্ডারওয়াটার রেস্টুরেন্ট, ভাসমান রেস্টুরেন্টসহ নানা বিনোদনের সুবিধা। কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা, এই কেন্দ্রটি বাস্তবায়িত হলে ১১ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

অন্যদিকে, মিয়ানমারের আপত্তির মুখে ২০২৩ সালে বন্ধ হয়ে গেছে নাফ ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়নকাজ। পরিশেষে বলা যায়, পরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়িত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব হবে।

Related Post

Leave a Comment