প্রেসিডেন্ট

মধ্যপ্রাচ্যের চলমান চরম উত্তেজনার মধ্যেই আকস্মিক এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আন্দোল্লাহিয়ানসহ ৯ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। রাইসির মৃত্যু ইরানের জন্য বিরাট এক ধাক্কা। ইব্রাহিম রাইসি ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলের বৈরিতা ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় প্রতিবেশীদের পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষভাবে মনোযোগ দেন।

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপট

১৯ মে ২০২৪ আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে যান ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। সেখান থেকে ১৭০ কিলোমিটার দূরে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরিজের উদ্দেশে যাত্রা করেন ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দোল্লাহিয়ান ও তাদের সঙ্গে থাকা অন্য কর্মকর্তারা।

আরো পড়ুন : পাহাড়-টিলা-হাওরের জেলা হবিগঞ্জ

৫৮ কিলোমিটার যাওয়ার পর ভারজাগান এলাকায় দুর্গম পাহাড়ে প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হলে সকলেই মারা যান। তবে এই বহরের অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে অবতরণ করে। প্রেসিডেন্ট রাইসি যে হেলিকপ্টারে ফিরছিলেন, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ‘বেল-২১২’ মডেলের। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা ‘ইউএইচ-১এন’ হেলিকপ্টারের বেসামরিক সংস্করণ এটি। ফ্লাইট গ্লোবালের হিসাবে, দেশটির বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর কাছে এ মডেলের ১০টি হেলিকপ্টার রয়েছে।

দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা

ইরানের প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টার সত্যিই দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল, নাকি এটি দেশটির প্রধান শত্রু ইসরায়েলের নাশকতা- তা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। ১ এপ্রিল ২০২৪ সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ইসরায়েল।

জবাবে ১৩- ১৪ এপ্রিল ২০২৪ রাইসির নেতৃত্বেই ইরান ইসরায়েলের ভূখণ্ডে প্রথমবার সরাসরি হামলা চালায়। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালাতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও সংগঠনের বড় পৃষ্ঠপোষক ইরান। ফলে ইরানকে সব সময়ই ঘায়েল করতে সচেষ্ট থাকে ইসরায়েল। এসব কারণে রাইসির হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেন ইসরায়েলবিরোধী কর্মী ও ভাষ্যকাররা।

বিপ্লবী থেকে প্রেসিডেন্ট

ইরানের প্রভাবশালী নেতাদের একজন ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। বর্ণাঢ্যময় কর্মজীবন ছিল তার। রাইসি রাজনৈতিক দিক থেকে
শিয়া ইসলামি কট্টরপন্থার সমর্থক। বিশ্ব নবীর রক্তসম্পর্কিত উত্তরাধিকার দাবি জানিয়ে সবসময় কালো রঙের পাগড়ি পরিধান করতেন তিনি। ধারণা করা হতো, তিনি একদিন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির উত্তরসূরি হবেন।

জন্ম ও কর্মজীবন : ১৪ ডিসেম্বর ১৯৬০ উত্তর-পূর্ব ইরানের পবিত্র শহর মাশহাদে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই তিনি ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে বড় হন। তিনি মোতাহারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি মাত্র ২০ বছর বয়সে তেহরানের পার্শ্ববর্তী শহর কারাজের প্রসিকিউটর-জেনারেল নিযুক্ত হন। এরপর ২৫ বছর বয়সে তেহরানে ডেপুটি প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮৯-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তেহরানের প্রসিকিউটর-জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সাল থেকে তিনি জুডিশিয়াল অথরিটির উপপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ৭ মার্চ ২০১৯ ইরানের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

প্রেসিডেন্ট : ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেন ইব্রাহিম রাইসি। কিন্তু রাইসিকে হারিয়ে নির্বাচনে জয়ী হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। তবে ২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন করে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ৩ আগস্ট ২০২১ তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট

ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানের ১৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দায়িত্বরত কোনো প্রেসিডেন্ট মারা গেলে বা কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে সক্ষম না হলে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার অনুমোদনক্রমে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন দেশটির প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট। ১৯ মে ২০২৪ বর্তমান প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মোখবারকে অন্তবর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

দেশটির সংবিধান অনুসারে, প্রেসিডেন্টের পদ শুন্য হওয়ার পরবর্তী ৫০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এখন বিধান অনুসারে ইরানে তিন সদস্যের একটি কাউন্সিল গঠন করা হবে। সেই কাউন্সিলের প্রধান হবেন মোহাম্মদ মোখবার। কাউন্সিলের অন্য দুই সদস্য ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার এবং বিচার বিভাগের প্রধান। ২৮ জুন ২০২৪ পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

Related Post

Leave a Comment